০১:৪৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
মৃত্যুর আগের রাতে বলেছিল ফরহাদ

‘চলেন ভাই শহীদ হয়ে আসি’

কুমারখালি-শ্রীপুর সড়ক থেকে দক্ষিণ বরাবর ইট বিন্যস্ত আধা কাঁচা রাস্তা বেয়ে গেছে রায়নগর জামে মসজিদের দিকে। রাস্তার দুপাশে ঘন সারি সারি বৃক্ষ তীব্র রোদে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদের ঠিক সামনেই খানিকটা ফাঁকা জায়গা, এর পাশে টিন শেডের মাদ্রাসা। কোণাকুণি উত্তরে কয়েক কদম দূরত্বে দেখা মিলে ছোট কবরস্থানের। এখানেই শুয়ে আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফরহাদ। তার সমাধিস্থলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সরু রাস্তা। এই সড়কের নামকরণও হয়েছে তার নামেই। রাস্তা এবং সমাধির মাঝামাঝি চৌকোনাকার এক স্মৃতিফলক বানানো হয়েছে। এর আস্তরণের ওপর কালো হরফে লেখা হয়েছে ‘শহীদ ফরহাদ হোসেন। পিতা: গোলাম মোস্তফা। জন্ম: ৬ ডিসেম্বর ২০০১, মৃত্যু: ৪ আগস্ট ২০২৪। ঠিকানা: রায়পুর, নাকল, শ্রীপুর, মাগুরা।’

স্বৈরাচার পতনে সক্রিয় এক যোদ্ধার নাম শহীদ ফরহাদ হোসেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল ছেলেটি। আন্দোলন সফল হওয়ার ঠিক একদিন আগে সে শাহাদাত বরণ করে। ৪ আগস্ট মাগুরা সদরের নতুন ব্রিজ এলাকায় সহপাঠীদের নিয়ে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল সে। বাকিরা বাড়িতে ফিরলেও সেদিন কয়েকজন তরুণ জীবন নিয়ে ফিরতে পারেনি। এরমধ্যে ফরহাদ অন্যতম।

ফরহাদের বাড়ি থেকে তার সমাধিস্থল খুব বেশি দূরে নয়। রায়নগর জামে মসজিদের পাশেই তাঁর পরিবারের আবাসস্থল। দু’চালা দুইটি ঘর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। মাঝে কিছুটা ফাঁকা জায়গা। সবকিছু আগের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেও ফরহাদের শূন্যতায় শোকের মাতম আঙিনাজুড়ে। অবশ্য ফরহাদ বরাবরই চুপচাপ ছেলে। প্রতিবেশি থেকে শ্রেণীকক্ষের শিক্ষক সবারই একই কথা, এমন ছেলে দ্বিতীয়টি হয় না।

মসজিদের আজানের ধ্বনি শুনে বেড়ে উঠেছিল ফরহাদ। আজান হলে মসজিদে সবার আগে নাকি তাকেই দেখা যেত। সে স্মৃতি স্মরণ করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মসজিদের ইমাম।

ঘাষিয়াড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসিবুল হক হাসিব ফরহাদকে দেখছেন ছোটবেলা থেকেই। ফরহাদের কথা স্মরণ করতে ভেঙে গেল তার বলিষ্ঠ গলা। আধোকণ্ঠে টলমল চোখে বললেন, ফরহাদ কখনো নামাজ কাজা (বাদ) করতো না। মিছিলে যাওয়ার আগেও সে নামাজ পড়েছে।

৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতনের দিন। আনন্দ বিষাদের এই দিনটিকে বাংলার মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করতে ঘাতকের বুলেটে ঝরেছে সহস্র প্রাণ। উষ্ণ রক্তে ভিজেছে বাংলার মৃত্তিকা, ধারণ করেছে রক্তবর্ণ। ‘জেন-জি’ প্রজন্ম স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে যে মহাকাব্য রচনা করেছে এতে মাগুরার অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেছেন ফরহাদেরা। কেবল ফরহাদই নয় গণমাধ্যম বলছে আন্দোলনে মাগুরায় শহীদ হয়েছেন আরও ৩ জন। ফরহাদের সাথে আন্দোলনে অংশ নেওয়া স্থানীয় শিক্ষার্থীরা জানান সেখানে অন্তত ১২ জন শহীদ হয়েছেন।

৩ আগস্ট রাতে মাগুরা পান্নাদুয়ালী ব্রিজের পাশে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ৪ আগস্ট নিরব মাগুরা শহর হঠাৎই জেগে ওঠে। দুপুরের যোহর নামাজ আদায় করে এতে যোগ দিয়েছিলেন ফরহাদ ও তার সহপাঠীরা। ওইদিন ফরহাদের সাথে থাকা তার এক স্থানীয় ছোটভাই জানান, সেদিন পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে গুলি ছুড়েছিল স্বৈরাচার হাসিনার দোসর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এর মধ্যে একটি গুলি আঘাত করে ফরহাদের মাথার ঠিক পেছনে। মুহুর্তেই মাটিতে ঢলে পড়ে ফরহাদের দেহ। তাকে বাঁচাতে ছুটে আসে তার সহযোদ্ধারা। ফরহাদ তখনো জেগে ছিল। তাকে হাসপাতালে নিতে পাড়ি দিতে হতো ছোট একটি সেতু। কিন্তু সে পথটাই ছিল অবরুদ্ধ।

তপু নামের একজন বলেন, যোহর আজান হলে আমরা একত্রিত হই। দুপুর ৩ টায় খাওয়া শেষ করে আমরা মিছিলে যাই। এরপরেই ফরহাদ ভাইয়ের মাথার পিছনে গুলি লাগে। আমরা হাসপাতালে নেওয়ার সময় সম্ভবত তিনি মারা যান।

সেদিন মৃত্যুর জন্য ফরহাদ বোধহয় প্রস্তুত হয়েই গিয়েছিলেন। হয়তো এজন্যই আগের দিন রাতে নিজ ভাইকে বলেছিল, ‘চলেন ভাই আমরা শহীদ হয়ে আসি’। কথাটি বলেতে গিয়ে কান্নায় ডুকরে উঠেন ফরহাদের ভাই গোলাম কিবরিয়া। তিনি বলেন, ‘রাতে তাজাজ্জুদের নামাজ পড়ে সে আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়েছে যেন তার শহীদি মৃত্যু হয়। সে আমাকেও আহবান করে।’

কিবরিয়া বলেন,’ আমি ওর বড় ভাই। আমাকেই ওর অনুসরণ করার কথা অথচ আমি ওর অনুসরণীয় হতে পারিনি, সে নিজেই অনুসরণীয়।’

ফরহাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা জানান, এমন নম্র ভদ্র ছেলে তারা খুব কমই দেখেছেন৷ কারো সাথেই তার কোন দ্বন্দ্ব ছিল না। সে ছিল নিরব প্রকৃতির।

নাকোল সম্মিলনী ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিল ফরহাদ। ছিল অল্প সময়ের মাদ্রাসা শিক্ষাও। পরিবারে ৪ ভাইবোন তারা। দুই বোনের একজন বিবাহিত। বড় ভাই কিবরিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

ফরহাদের স্থানীয় এক চাচা বলেন, এই পরিবারটি অন্যান্য আর ১০ টা পরিবার থেকে আলাদা। প্রত্যেকেই ধর্মকর্ম করে। ফরহাদ মারা গেলে তার বাবা মৃত্যকে এতো সহজ করে মেনে নিয়েছেন যে তা দেখলে আমরা অবাক হয়ে যাই। এই পরিবারটি কখনোই কারো থেকে সাহায্যের জন্য মুখ খুলবে না। আমাদের সকলের উচিৎ ওদের পাশে দাঁড়ানো।

ফরহাদের বাবা গোলাম মোস্তফা নারায়ণগঞ্জের একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়েই বাড়িতে ছুটে আসেন। তবে ছেলের শহীদ হওয়া তার জন্য ছিল গর্বের। সৃষ্টিকর্তা ওপর ভরসা রেখে কয়েকদিন পরেই ফিরেছেন কর্মস্থলে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস পরিবার থেকে সম্মানিত শিক্ষক এবং ফরহাদের সহপাঠীরা মিলে আমরা ৫ সেপ্টেম্বর মাগুরার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। উদ্দেশ্য ছিল দুইটি এই বিভাগের দুই শহীদ শিক্ষার্থী ফরহাদ এবং হৃদয় তরুয়ার সমাধিস্থল দেখে আসা, তাদের পরিবারের খোঁজ নেওয়ার মাধ্যমে কিছুটা ভরসা দেওয়া এবং দোয়ার আয়োজন করা।

ফরহাদের কবর জিয়ারতের পর সন্ধ্যার মাগরিবের নামাজ আদায় শেষে নিকটস্থ মাদ্রাসায় এক দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।

দোয়া মাহফিলে ফরহাদের প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক হাসিবুল হক হাসিব বলেন, এতো ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই অর্জন ছাত্রসমাজকে ধরে রাখতে হবে। ফরহাদের মতো আরও যারা এই আন্দোলনে যারা নিজেদের প্রাণ দিয়েছে তাদেরকে আমাদের মনে রাখতে হবে।

ফরহাদের চবি ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আমার সাথে ওর লাইব্রেরিতে দেখা হতো। ছেলেটা নম্র ও ভদ্র। আমরা ফরহাদের স্মৃতি ধরে রাখতে ইতিহাস বিভাগের সিলেবাস তার নামে উৎসর্গ করেছ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার পরিবারের কাউকে যেন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এজন্য আমরা প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছি। তার এই আত্মত্যাগ যেন আমরা ভুলে না যাই।

[লেখাটির তথ্য সংযোজন হয়েছে ৬-১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪]

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

জনপ্রিয়

মৃত্যুর আগের রাতে বলেছিল ফরহাদ

‘চলেন ভাই শহীদ হয়ে আসি’

০২:১৫:৫৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫

কুমারখালি-শ্রীপুর সড়ক থেকে দক্ষিণ বরাবর ইট বিন্যস্ত আধা কাঁচা রাস্তা বেয়ে গেছে রায়নগর জামে মসজিদের দিকে। রাস্তার দুপাশে ঘন সারি সারি বৃক্ষ তীব্র রোদে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদের ঠিক সামনেই খানিকটা ফাঁকা জায়গা, এর পাশে টিন শেডের মাদ্রাসা। কোণাকুণি উত্তরে কয়েক কদম দূরত্বে দেখা মিলে ছোট কবরস্থানের। এখানেই শুয়ে আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফরহাদ। তার সমাধিস্থলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সরু রাস্তা। এই সড়কের নামকরণও হয়েছে তার নামেই। রাস্তা এবং সমাধির মাঝামাঝি চৌকোনাকার এক স্মৃতিফলক বানানো হয়েছে। এর আস্তরণের ওপর কালো হরফে লেখা হয়েছে ‘শহীদ ফরহাদ হোসেন। পিতা: গোলাম মোস্তফা। জন্ম: ৬ ডিসেম্বর ২০০১, মৃত্যু: ৪ আগস্ট ২০২৪। ঠিকানা: রায়পুর, নাকল, শ্রীপুর, মাগুরা।’

স্বৈরাচার পতনে সক্রিয় এক যোদ্ধার নাম শহীদ ফরহাদ হোসেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল ছেলেটি। আন্দোলন সফল হওয়ার ঠিক একদিন আগে সে শাহাদাত বরণ করে। ৪ আগস্ট মাগুরা সদরের নতুন ব্রিজ এলাকায় সহপাঠীদের নিয়ে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল সে। বাকিরা বাড়িতে ফিরলেও সেদিন কয়েকজন তরুণ জীবন নিয়ে ফিরতে পারেনি। এরমধ্যে ফরহাদ অন্যতম।

ফরহাদের বাড়ি থেকে তার সমাধিস্থল খুব বেশি দূরে নয়। রায়নগর জামে মসজিদের পাশেই তাঁর পরিবারের আবাসস্থল। দু’চালা দুইটি ঘর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। মাঝে কিছুটা ফাঁকা জায়গা। সবকিছু আগের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেও ফরহাদের শূন্যতায় শোকের মাতম আঙিনাজুড়ে। অবশ্য ফরহাদ বরাবরই চুপচাপ ছেলে। প্রতিবেশি থেকে শ্রেণীকক্ষের শিক্ষক সবারই একই কথা, এমন ছেলে দ্বিতীয়টি হয় না।

মসজিদের আজানের ধ্বনি শুনে বেড়ে উঠেছিল ফরহাদ। আজান হলে মসজিদে সবার আগে নাকি তাকেই দেখা যেত। সে স্মৃতি স্মরণ করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মসজিদের ইমাম।

ঘাষিয়াড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসিবুল হক হাসিব ফরহাদকে দেখছেন ছোটবেলা থেকেই। ফরহাদের কথা স্মরণ করতে ভেঙে গেল তার বলিষ্ঠ গলা। আধোকণ্ঠে টলমল চোখে বললেন, ফরহাদ কখনো নামাজ কাজা (বাদ) করতো না। মিছিলে যাওয়ার আগেও সে নামাজ পড়েছে।

৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতনের দিন। আনন্দ বিষাদের এই দিনটিকে বাংলার মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করতে ঘাতকের বুলেটে ঝরেছে সহস্র প্রাণ। উষ্ণ রক্তে ভিজেছে বাংলার মৃত্তিকা, ধারণ করেছে রক্তবর্ণ। ‘জেন-জি’ প্রজন্ম স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে যে মহাকাব্য রচনা করেছে এতে মাগুরার অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেছেন ফরহাদেরা। কেবল ফরহাদই নয় গণমাধ্যম বলছে আন্দোলনে মাগুরায় শহীদ হয়েছেন আরও ৩ জন। ফরহাদের সাথে আন্দোলনে অংশ নেওয়া স্থানীয় শিক্ষার্থীরা জানান সেখানে অন্তত ১২ জন শহীদ হয়েছেন।

৩ আগস্ট রাতে মাগুরা পান্নাদুয়ালী ব্রিজের পাশে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ৪ আগস্ট নিরব মাগুরা শহর হঠাৎই জেগে ওঠে। দুপুরের যোহর নামাজ আদায় করে এতে যোগ দিয়েছিলেন ফরহাদ ও তার সহপাঠীরা। ওইদিন ফরহাদের সাথে থাকা তার এক স্থানীয় ছোটভাই জানান, সেদিন পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে গুলি ছুড়েছিল স্বৈরাচার হাসিনার দোসর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এর মধ্যে একটি গুলি আঘাত করে ফরহাদের মাথার ঠিক পেছনে। মুহুর্তেই মাটিতে ঢলে পড়ে ফরহাদের দেহ। তাকে বাঁচাতে ছুটে আসে তার সহযোদ্ধারা। ফরহাদ তখনো জেগে ছিল। তাকে হাসপাতালে নিতে পাড়ি দিতে হতো ছোট একটি সেতু। কিন্তু সে পথটাই ছিল অবরুদ্ধ।

তপু নামের একজন বলেন, যোহর আজান হলে আমরা একত্রিত হই। দুপুর ৩ টায় খাওয়া শেষ করে আমরা মিছিলে যাই। এরপরেই ফরহাদ ভাইয়ের মাথার পিছনে গুলি লাগে। আমরা হাসপাতালে নেওয়ার সময় সম্ভবত তিনি মারা যান।

সেদিন মৃত্যুর জন্য ফরহাদ বোধহয় প্রস্তুত হয়েই গিয়েছিলেন। হয়তো এজন্যই আগের দিন রাতে নিজ ভাইকে বলেছিল, ‘চলেন ভাই আমরা শহীদ হয়ে আসি’। কথাটি বলেতে গিয়ে কান্নায় ডুকরে উঠেন ফরহাদের ভাই গোলাম কিবরিয়া। তিনি বলেন, ‘রাতে তাজাজ্জুদের নামাজ পড়ে সে আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়েছে যেন তার শহীদি মৃত্যু হয়। সে আমাকেও আহবান করে।’

কিবরিয়া বলেন,’ আমি ওর বড় ভাই। আমাকেই ওর অনুসরণ করার কথা অথচ আমি ওর অনুসরণীয় হতে পারিনি, সে নিজেই অনুসরণীয়।’

ফরহাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা জানান, এমন নম্র ভদ্র ছেলে তারা খুব কমই দেখেছেন৷ কারো সাথেই তার কোন দ্বন্দ্ব ছিল না। সে ছিল নিরব প্রকৃতির।

নাকোল সম্মিলনী ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিল ফরহাদ। ছিল অল্প সময়ের মাদ্রাসা শিক্ষাও। পরিবারে ৪ ভাইবোন তারা। দুই বোনের একজন বিবাহিত। বড় ভাই কিবরিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

ফরহাদের স্থানীয় এক চাচা বলেন, এই পরিবারটি অন্যান্য আর ১০ টা পরিবার থেকে আলাদা। প্রত্যেকেই ধর্মকর্ম করে। ফরহাদ মারা গেলে তার বাবা মৃত্যকে এতো সহজ করে মেনে নিয়েছেন যে তা দেখলে আমরা অবাক হয়ে যাই। এই পরিবারটি কখনোই কারো থেকে সাহায্যের জন্য মুখ খুলবে না। আমাদের সকলের উচিৎ ওদের পাশে দাঁড়ানো।

ফরহাদের বাবা গোলাম মোস্তফা নারায়ণগঞ্জের একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়েই বাড়িতে ছুটে আসেন। তবে ছেলের শহীদ হওয়া তার জন্য ছিল গর্বের। সৃষ্টিকর্তা ওপর ভরসা রেখে কয়েকদিন পরেই ফিরেছেন কর্মস্থলে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস পরিবার থেকে সম্মানিত শিক্ষক এবং ফরহাদের সহপাঠীরা মিলে আমরা ৫ সেপ্টেম্বর মাগুরার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। উদ্দেশ্য ছিল দুইটি এই বিভাগের দুই শহীদ শিক্ষার্থী ফরহাদ এবং হৃদয় তরুয়ার সমাধিস্থল দেখে আসা, তাদের পরিবারের খোঁজ নেওয়ার মাধ্যমে কিছুটা ভরসা দেওয়া এবং দোয়ার আয়োজন করা।

ফরহাদের কবর জিয়ারতের পর সন্ধ্যার মাগরিবের নামাজ আদায় শেষে নিকটস্থ মাদ্রাসায় এক দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।

দোয়া মাহফিলে ফরহাদের প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক হাসিবুল হক হাসিব বলেন, এতো ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই অর্জন ছাত্রসমাজকে ধরে রাখতে হবে। ফরহাদের মতো আরও যারা এই আন্দোলনে যারা নিজেদের প্রাণ দিয়েছে তাদেরকে আমাদের মনে রাখতে হবে।

ফরহাদের চবি ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আমার সাথে ওর লাইব্রেরিতে দেখা হতো। ছেলেটা নম্র ও ভদ্র। আমরা ফরহাদের স্মৃতি ধরে রাখতে ইতিহাস বিভাগের সিলেবাস তার নামে উৎসর্গ করেছ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার পরিবারের কাউকে যেন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এজন্য আমরা প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছি। তার এই আত্মত্যাগ যেন আমরা ভুলে না যাই।

[লেখাটির তথ্য সংযোজন হয়েছে ৬-১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪]